সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ০২:৪৪ অপরাহ্ন

সাম্রাজ্যে ফিরতে তৎপর ক্যাসিনো হোতারা

সাম্রাজ্যে ফিরতে তৎপর ক্যাসিনো হোতারা

স্বদেশ ডেস্ক:

২০১৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর দেশে আকস্মিক শুরু হয় ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান। রাজধানীর বিভিন্ন ক্যাসিনো আস্তানায় হানা দেয় র‌্যাব। একে একে গ্রেপ্তার করা হয় প্রভাবশালী রাজনীতিক, জনপ্রতিনিধিসহ অনেককে। র‌্যাবের পক্ষ থেকে তখন বলা হয়, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, আধিপত্য বিস্তার ও দখলদারিত্বের সুনির্দিষ্ট অভিযোগে তাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। একের পর এক অভিযানে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে মতিঝিল ক্লাবপাড়ায়। এর পর একসময় বন্ধ হয়ে যায় ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান। ফলে এ নিয়ে দেশব্যাপী যে আলোচনা শুরু হয়েছিল, সেটিও একসময় থিতিয়ে আসে।

প্রায় এক বছর আগে শুরু হওয়া সে অভিযানের কারণে যারা গা ঢাকা দিয়েছিলেন; গ্রেপ্তার এড়াতে পাড়ি জমিয়েছিলেন বিভিন্ন দেশে, তাদের অনেকেই ইতোমধ্যে দেশে ফিরে এসেছেন। চলে গিয়েছিলেন লোকচক্ষুর অন্তরালে, ফিরেছেন জনসমক্ষে। গা ঢাকা দেওয়া সেসব কেউকেটাদের মধ্যে কেউ কেউ জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিতও হয়েছেন। সর্বশেষ সংবাদ, নিজেদের হারানো সেই সাম্রাজ্য ফিরে পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন তাদের কেউ কেউ।

ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান প্রথম শুরু হয় রাজধানীর ফকিরাপুলের ইয়ংমেনস ক্লাবে। অভিযানের দিন সন্ধ্যায় যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর পর একে একে গ্রেপ্তার করা হয় যুবলীগের আরও অনেক নেতাকে। তাদের মধ্যে রয়েছেন এসএম গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জিকে শামীম, মো. লোকমান হোসেন ভূঁইয়া, ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট, সম্রাটের সহযোগী এনামুল হক আরমান প্রমুখ। পরে তাদের যুবলীগ থেকে বহিষ্কারও করা হয়। এ ছাড়া মোহাম্মদ শফিফুল আলম ফিরোজ, অনলাইন ক্যাসিনোর প্রধান সমন্বয়কারী সেলিম প্রধান, ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজান, আলোচিত কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজীব এবং ৩৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা ময়নুল হক ওরফে মনজুকেও গ্রেপ্তার করা হয়।

ইয়ংমেনস ক্লাব ছাড়াও ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান চালানো দেশের আলোচিত ক্লাবের মধ্যে রয়েছে- মতিঝিলের ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, গুলিস্তানের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়াচক্র, কলাবাগান ক্রীড়াচক্র, ধানমণ্ডি ক্লাব, ফু-ওয়াং ক্লাব, চট্টগ্রামের মুক্তিযোদ্ধা ক্লাব, আবাহনী ক্লাব, মোহামেডান ক্লাব। এ ছাড়া বনানীর গোল্ডেন ঢাকা বাংলাদেশসহ বেশ কয়েকটি ক্যাসিনোতে অভিযান পরিচালনা করা হয়।

প্রায় দেড় মাস ধরা চলা অভিযানে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি (পরবর্তী সময় বহিষ্কৃৃত) ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটসহ প্রভাবশালী ১১ জন গ্রেপ্তার হন। অভিযানের মধ্যেই ক্যাসিনোকাণ্ডে, দখলবাজি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ নানা অভিযোগে অভিযুক্ত অনেকেই দেশ ছেড়ে পালান; কেউবা দেশেই গা ঢাকা দেন। সেই অভিযান চলাকালে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠেছিল তাদের মধ্যে কয়েকজন ক্ষমতাসীন দলের সমর্থনপুষ্ট হয়ে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে নির্বাচনে অংশ নিয়ে ওয়ার্ড কাউন্সিলরও হয়েছেন। পরিস্থিতি এখন আর প্রতিকূলে নেই- এমন ভাবনা থেকে ক্যাসিনোকাণ্ডের সুবিধাভোগী ও নেপথ্য হোতাদের অনেকে দেশে ফিরেছেন এবং প্রকাশ্যে চলাফেরা করছেন।

সংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকটি সূত্রের খবর, অভিযান শেষ হওয়ার পর বেশ কয়েকবার দেশে এসেছিলেন ক্যাসিনোকাণ্ডে আলোচিত যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের বহিষ্কৃত সাংগঠনিক সম্পাদক মমিনুল হক সাঈদ, কেন্দ্রীয় সদস্য মিজানুর রহমান, ছাত্রলীগের সাবেক নেতা শেখ রবিউল ইসলাম সোহেল, গুলিস্তানের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়াচক্রের ইজারাদার ক্যাসিনোর আলী বাবা নামে খ্যাত আলী আহমেদ, গুলিস্তান এলাকার মার্কেটখেকো হিসেবে পরিচিত দেলোয়ার হোসেন ওরফে দেলু। এ ছাড়া গুলিস্তান এলাকার একজন কাউন্সিলর আছেন। কথিত আছে, তার কব্জায় ছিল মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়াচক্র। অভিযানকালে তিনি গা ঢাকা দিলেও পরবর্তী সময় আওয়ামী লীগের সমর্থনে পুনরায় কাউন্সিলর নির্বাচিত হন।

গুলিস্তান এলাকার বেশ কয়েকজন সরকারদলীয় রাজনৈতিক নেতা ও মার্কেট সমিতির নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়াচক্রের ইজারাদার আলী আহমেদ দেশে ফিরেছেন। করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার আগে তিনি বেশ কয়েকবার গুলিস্তানেও গিয়েছিলেন। একাধিক সূত্রের খবর, তিনি মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়াচক্র পুনরায় কব্জায় নেওয়ার চেষ্টা করছেন। তবে করোনা শুরু হওয়ার পর থেকে তাকে আর দেখা যায়নি। আলী আহমেদকে না দেখা গেলেও গুলিস্তান এলাকায় সক্রিয় তার ছেলে।

অভিযোগ আছে, ফুলবাড়িয়ার জাকের প্লাজা, নগর প্লাজাসহ আশপাশের মার্কেটের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক ছিলেন দেলোয়ার হোসেন ওরফে দেলু। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু হওয়ার পরে তিনি গা ঢাকা দেন। অভিযান থেমে গেলে ফিরে এসে পুরনো প্রভাববলয় তৈরি করেন তিনি। একাধিক বৈঠকও করেন সংশ্লিষ্ট মার্কেটের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে।

ফুলবাড়িয়ার জাকের প্লাজা, নগর প্লাজাসহ আশপাশের মার্কেটের একাধিক ব্যবসায়ী আমাদের সময়কে জানিয়েছেন, অভিযান শেষ হওয়ার কিছুদিন পরেই দেলু দেশে ফিরে আসেন। এর পর বেশ কয়েকবার মার্কেট সমিতির নেতাদের নিয়ে প্রকাশ্য বৈঠকও করেন।

একই অবস্থা মতিঝিল এলাকার বহিষ্কৃৃত কাউন্সিলর মমিনুল হক সাঈদের ক্ষেত্রেও। অভিযান বন্ধ হওয়ার পরে অন্তত দুই দফা তিনি দেশে ফিরেছিলেন। ওই সময়ে তার সঙ্গে আমাদের সময়ের প্রতিবেদকের কথাও হয়। তবে বর্তমানে তিনি কোথায় রয়েছেন তা জানা যায়নি।

ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানকালে ঢাকা উত্তর সিটি ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বেশ কয়েক কাউন্সিলরের নাম আলোচনায় আসে। অনেকের বিরুদ্ধে মাদক, জুয়া, ক্যাসিনো, দখলসহ নানা অভিযোগ উঠেছিল। তবে অভিযোগ ওঠা এমন রাজধানীর অন্তত পাঁচজন কাউন্সিলর পুনরায় ক্ষমতাসীন দলের টিকিটে কাউন্সিলর নির্বাচিত হন।

দখল, চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগে অভিযানকালে যুবলীগ নেতা তাইজুল ইসলাম চৌধুরী বাপ্পী গা ঢাকা দিয়েছিলেন। তবে অভিযান শেষে আবার স্বরূপে ফিরে আসেন। এমনকি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে জয়লাভও করেন।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্র জানায়, অভিযানের সময় এমন অনেকের নাম আলোচনায় এলেও বিদেশে পালিয়ে যাওয়ায় কিংবা দেশেই গা ঢাকা দেওয়ায় তাদের অনেকেই গ্রেপ্তার হননি। এ ছাড়া গ্রেপ্তারকৃতরা জিজ্ঞাসাবাদে তাদের নেপথ্য হোতা হিসেবে প্রভাবশালী অনেকের নামই বলেছিলেন। তাদের মধ্যে রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি থেকে শুরু করে সরকারি অনেক গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাও আছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের আঁচ তাদের গায়ে লাগেনি।

যুবলীগের সাবেক চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী, সাবেক দপ্তর সম্পাদক আনিসুর রহমান, যুবলীগের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাংসদ নুরুন্নবী চৌধুরী শাওনের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়। এ ছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু হওয়ার পর তিনজন সাংসদসহ ২৩ জনের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোল্লা মো. আবু কাওছারকে। স্বেচ্ছাসেবক লীগের কার্যক্রম থেকে সরিয়ে রাখা হয় সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ দেবনাথকেও।

৪৯টি অভিযানে গ্রেপ্তার ২৭৫ জন

ক্যাসিনোবিরোধী ৪৯টি অভিযান পরিচালিত হয়। এর মধ্যে ৩২টি র‌্যাব এবং ১৭টি অভিযান পুলিশ পরিচালনা করে। এসব অভিযানে ২৭৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর মধ্যে ঢাকায় ২২২ জন এবং ঢাকার বাইরে ৫৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এতে যুবলীগ, আওয়ামী লীগ ও কৃষক লীগের প্রভাবশালী নেতাদেরও গ্রেপ্তার করা হয়। এই সময়ের মধ্যে ১১টি ক্যাসিনো ও ক্লাবে অভিযান চালিয়েছে র‌্যাব। এসব অভিযানে ৮ কোটি ৪৫ লাখ টাকা, ১৬৬ কোটি টাকার এফডিআর, ১৩২টি বিভিন্ন ব্যাংকের চেক বই এবং ১১ কোটি ৭৭ লাখ টাকার চেক জব্দ করা হয়। এ ছাড়া আট কেজি স্বর্ণ, ২২টি অবৈধ আগ্নেয়ান্ত্র এবং বিপুল পরিমাণ বিদেশি মদ ও ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। এসব ঘটনায় করা হয় ৩২টি মামলা। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ১৪টি মামলার তদন্ত করে র‌্যাব। ১৩টি মামলার চার্জশিট আদালতে দাখিল করা হয়েছে। এখনো ১টি মামলা তদন্ত পর্যায়ে রয়েছে। এ ছাড়া বাকি ১৮টি মামলা তদন্ত করে পুলিশ। পুলিশের তদন্ত করার মামলাগুলোর মধ্যে তিনটি মামলায় আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে।

জামিনে মুক্ত ফিরোজ ও লোকমান

ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে গ্রেপ্তার হওয়া কলাবাগান ক্রীড়াচক্রের সভাপতি ও কৃষক লীগ নেতা শফিকুল আলম ফিরোজ ও মোহামেডান ক্লাবের পরিচালক লোকমান হোসেন ভূঁইয়া জামিনে বেরিয়ে গেছেন। গত ১৯ মার্চ লোকমান হোসেন ভূঁইয়া কাশিমপুর-১ থেকে ও ১ জানুয়ারি শফিকুল আলম ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পান।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ আমাদের সময়কে বলেন, ‘র‌্যাবের কাছে থাকা মামলাগুলোর মধ্যে একটি ছাড়া সব তদন্ত শেষে চার্জশিট প্রদান করা হয়েছে। মামলায় অভিযুক্ত কেউ ফিরে এলে তদন্ত কর্মকর্তা প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।’

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877